আলিনা নিখোঁজ হলে ১০ দিন পর্যন্ত মা–বাবা অপেক্ষায় ছিলেন, এই বোধ হয় মেয়ে ঘরে ফিরল। কিন্তু মা–বাবা এখন জেনে গেছেন তাঁদের কলিজার টুকরা মেয়েকে কয়েক টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন মেয়েটির স্বজনেরা সাগরপাড়ে ছুটছেন, যদি তার শরীরের কোনো টুকরা, জামা, জুতা, হিজাব বা অন্য কিছু পাওয়া যায়, সে আশায়। আলিনার বাবা মো. সোহেল রানা মুঠোফোনে বললেন, ‘কলিজার শরীরের একটা টুকরাও যদি পাইতাম, দাফনটা তো করতে পারতাম। কলিজার তো কিছুই পাইলাম না।’
আজ রোববার বিকেলে আলিনা ইসলাম আয়াতের বাবা সোহেল রানার সঙ্গে কথা হয়। বললেন, সাগরপাড়ে গিয়ে তাঁরা আলিনার যদি কোনো আলামত পাওয়া যায়, তাই খুঁজছেন। নিজে থেকেই বললেন, ‘আমার মেয়েটা আমার সঙ্গে দোকানে গিয়ে লুকোচুরি খেলত। ঘটনার দিনও দোকানে বসে তার মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে। মেয়েটা আচার খেতে চায়। মেয়ের তো আচার খাওয়া শেষ, আর খাবে না।’
১৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা ওয়াজ মুন্সিবাড়ি এলাকার সোহেল রানার মেয়ে আলিনা বাসার পাশে একটি মক্তবে বিকেলে পড়তে যায়। তারপর জানা যায়, আলিনা মক্তবে যায়নি। আশপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে ইপিজেড থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। এরপর ২৫ নভেম্বর আলিনার পরিবার জানতে পারে, পাঁচ বছর বয়সী আলিনা অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছে। অপহরণকারী আর কেউ নন, তিনি হলেন আবির আলী (১৯), যাঁর পরিবার সোহেল রানার বাসায় দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া থাকছেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বৃহস্পতিবার আবিরকে আটকের পর জানতে পারে, এই তরুণ আলিনাকে হত্যা করে ছোট্ট লাশটিকে কেটে ছয় টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছেন। এর পর থেকেই আলিনার বাবা, দাদাসহ স্বজনেরা সাগরপাড়ে ছুটছেন তার শরীরের কোনো একটি টুকরা যদি ভেসে আসে, সে আশায়।
আলিনা ছিল সোহেল রানার একমাত্র মেয়ে। জানালেন, তাঁর বাসা থেকে সাগরের দূরত্ব এক থেকে দুই কিলোমিটার। বললেন, ‘সাগরপাড়ে গিয়া আজকেও খুঁজলাম, কিছুই পাই নাই।’ মুঠোফোনে এ বাবা একটু পরপর ‘ওহ’ বলে আর্তচিৎকার করছিলেন। প্রতিবেদকের কাছেই বারবার জানতে চাইছিলেন, তাঁর এইটুকুন নিষ্পাপ মেয়েটাকে কেমনে মারল? কেন মারল? বললেন, ‘কলিজাকে যখন মারছে তখন মনে হয়, আব্বু আব্বু বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। ইশ্, কত কষ্ট করে মইরা গেল মেয়েটা।’
সোহেল রানার চোখের সামনে এখনো ভাসছে তাঁর ছোট রাজকন্যা, কলিজার টুকরা মেয়েটা হাসছে, খেলছে। বললেন, ‘আমার কলিজার টুকরার অনেক বুদ্ধি ছিল। বাড়ির ঠিকানা বলতে পারত। টিকটক ভিডিও করত। ফোনে ভয়েস কল করতে পারত…।’
আবিরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পিবিআই জানিয়েছে, ছয়-সাত লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আলিনাকে অপহরণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মুঠোফোনের সিম কাজ না করায় মুক্তিপণের জন্য আলিনার পরিবারকে কল দিতে পারেননি। নিজে ধরা পড়ে যাবেন, এই ভয়ে আলিনাকে কেটে ছয় টুকরা করেন। সত্যিকারের অপরাধের ঘটনা নিয়ে তৈরি ভারতের টিভি ধারাবাহিক ক্রাইম প্যাট্রল দেখে আবির এমন পরিকল্পনা করেছিলেন।
সোহেল রানা কখনোই আবিরকে সন্দেহ করেননি বলে জানালেন। আলিনা নিখোঁজের পর আবিরও তাঁদের সঙ্গে মিলে মেয়েটিকে খোঁজাখুঁজি করেছেন। সোহেল রানা জানালেন, একটি ডায়েরিতে আবির বড়লোক হতে চান, সে কথা লিখে রেখেছেন বলে জানতে পেরেছেন।
আলিনার হত্যাকারীর কী শাস্তি চান, সে প্রশ্নের জবাবে সোহেল রানা বললেন, ‘মেয়ের লাশটাই তো পাইলাম না। লাশ বা একটা টুকরা পাইলেও তো একটু সান্ত্বনা পাইতাম। আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাই।’
আলিনা হত্যার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার আবিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেন শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আয়াতের কোনো আলামত পাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে সাগরপাড়ে তিন দিন ধরে অভিযান চলছে। ১৫ নভেম্বর আয়াত নিখোঁজ হয়, ১৬ নভেম্বর সকালেই তার লাশের টুকরা সাগরে ফেলা হয়েছে। আসামি আবিরের জবানবন্দি অনুযায়ী এ অভিযান চলছে। সাগরপাড়ে কিছু পাওয়া যাবে কি না জানি না, তবে চেষ্টা তো করতে হবে। অভিযানের সময় আয়াতের বাবা, দাদাসহ অন্যান্য স্বজনও উপস্থিত থাকছেন।’
নিখোঁজের পর থেকেই আর্জেন্টিনা দলের সাদা-আকাশি রঙের জার্সি পরা আলিনার একটি ছবি ফেসবুকে ঘুরছে। তাতে আলিনার বাবার ফোন নম্বরও দেওয়া ছিল। এ ছবি বিভিন্নজন শেয়ার করে মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন। অনেকে আলিনাকে পাওয়া গেছে বলে গুজবও রটিয়েছেন। অনেক ইউটিউবার মেয়েটিকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে বলেও প্রচার করেছেন। আলিনার মৃত্যু ও কয়েক টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার খবরে ফেসবুকে অনেকে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। আলিনার বাবার মতোই অনেকে ফেসবুকে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
আলিনার মা তামান্না ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়নি। প্রথম আলোর চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক গাজী ফিরোজ আজ দুপুরে তাঁদের বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছেন। তিনি মুঠোফোনে জানালেন, তামান্না ইসলাম কোনো কথা বলছেন না। তিনি বাক্রুদ্ধ। মুঠোফোনের স্ক্রিনে মেয়ের ছবির দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বললেন, অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। মা–বাবাকেও সন্তানের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। প্রায় একই কথা বললেন সন্তানের বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের’ নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা। তিনি আলিনার ঘটনা নিয়ে বললেন, এই আবির আলিনাকে আদর করতেন, এ নিয়ে সন্দেহ নয়, আলিনার মা–বাবাকে সচেতন থাকতে হতো। একই কথা অন্যদের জন্যও প্রযোজ্য।
আবির বেশ কয়েক দিন ধরেই আলিনাকে অপহরণ করার চিন্তা করছিলেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। আলিনার বাবা সোহেল রানা চট্টগ্রামের ইপিজেড থানায় মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ঘটনার দিন আলিনা যখন মসজিদের পাশে খেলছিল, তখন আবির তাকে আদর করছিলেন। এলাকার কয়েকজন এ দৃশ্য দেখেছিলেন। সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, আবির আলিনাকে আদর করেছেন, এ তথ্য জানার পরই মূলত তাঁকে সন্দেহ করা শুরু করেন তাঁরা।
Leave a Reply